রবিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৪

বীরমাতা

৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হন সিরাজগঞ্জের বীরাঙ্গনারা। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর তাদের ভাগ্যে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিললেও এখনও গেজেট প্রকাশ হয়নি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পরিবার থেকে বিছিন্ন হওয়া ৩৫ জন বীরাঙ্গনা সিরাজগঞ্জ শহরের ‘নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে’ আশ্রয় নেন। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। ‘সিরাজগঞ্জ নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র।’ এখানেই থাকতেন ওই ৩৫ বীর নারী। কিন্তু কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তারা আবারও সমাজের নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মুখ লুকিয়ে রাখতে শুরু করেন। এ ৩৫ জন বীর নারীর মধ্যে ইতিমধ্যেই ১৭ জন মারা গেছেন। আর বেঁচে থাকা ১৮ জনের মধ্যে অনেকেই এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন আরিফের নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জ শহর দখল করে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন চালাতে শুরু করে। ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে বর্বরোচিত এ কার্যক্রম। হানাদার বাহিনী নির্মম নির্যাতনের সেই দিনগুলোর স্মৃতি মনে হলে এখনও কেঁদে ওঠেন তারা। 

কমলা বেগম, স্বামী মৃত, শুকুর আলী, ভিক্টোরিয়া স্কুল রোড, সিরাজগঞ্জ। যুদ্ধের সময় পাকবাহিনীর হামলার ভয়ে তিনি পৈতৃক ভিটা ছেড়ে খোকসাবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেন। ২০ অথবা ২২শে এপ্রিল কতিপয় রাজাকার আশ্রয় কেন্দ্র থেকে তাকে ধরে নিয়ে যায়। ৩দিন আটকে রেখে তার ওপর চালানো হয় পাশবিক নির্যাতন। পরে অসুস্থ অবস্থায় সে ছাড়া পেলেও তার স্বামী আর তাকে গ্রহণ করেনি। এখনও সে পিতৃগৃহেই বসবাস করছেন। রহিমা বেগম, স্বামী-রিয়াজ উদ্দিন, চককোবদাসপাড়া, সিরাজগঞ্জ। পাকবাহিনীর রোষানল থেকে বাঁচতে অনেকের মতো তিনিও নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে একই গ্রামের রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকসেনারা ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা রহিমাকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। সেখানে নির্যাতনের একপর্যায়ে তার অনাগত সন্তান নষ্ট হয়ে যায়। নির্যাতনের সেই ভয়াল স্মৃতি তিনি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন।  

রোকেয়া খাতুন, স্বামী মৃত, আমজাদ হোসেন তালুকদার, সয়াধানগড়া-সিরাজগঞ্জ। সিরাজগঞ্জ শহর পাকসেনাদের দখলে চলে যাওয়ার পর পরিবারের সবাইকে নিয়ে রোকেয়া পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিলেন। স্থানীয় রাজাকাররা তাদের আশ্রয় দেয়ার কথা বলে বাড়িতে নিয়ে যায়। ১লা মে ওই গ্রাম ঘেরাও করে নির্যাতন চালায় পাকসেনারা এবং রোকেয়াকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। এরপর শহরের ওয়াপদা অফিসে স্থাপিত ক্যাম্পে ১০ দিন আটকে রেখে তার ওপর চালানো হয় নির্যাতন। পরে সে ফিরে এলেও স্বামীর বাড়িতে তার আর ঠাঁই হয়নি।  

নূরজাহান বেগম, স্বামী রস্তম সেখ, সয়াধানগড়া-সিরাজগঞ্জ। যুদ্ধকালীন স্বামীর বাড়ি থেকে এলাকার মুখচেনা কয়েকজন রাজাকার তাকে ধরে নিয়ে যায়। এরপর শহরের ওয়াপদা ক্যাম্পে নিয়ে তার পরনের কাপড় খুলে লোকজনের সামনেই বিবস্ত্র করা হয়। এরপর নির্যাতন করে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। বাড়িতে ফিরে আসার পর সমাজ তাকে মেনে না নেয়ায় দীর্ঘদিন তাকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে হয়। 

রাহিলা বেগম, স্বামী আকবর আলী, শিবনাথপুর, শিয়ালকোল-সিরাজগঞ্জ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র ৬ মাস আগে তার বিয়ে হয়। স্বামী সংসারে তখন সে সুখের স্বপ্ন বিভোর। এরপর যুদ্ধ শুরু হলে পাকসেনা ও রাজাকাররা তার গ্রামে হানা দেয়। এসময় তার স্বামী পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও ধরা পড়েন রাহিলা। এরপর টানা ১৭ দিন ক্যাম্পে আটকে রেখে তার ওপর নির্যাতন চালানো হয়। ফিরে আসার পর স্বামী আর তাকে গ্রহণ করেনি। বর্তমানে সে শহরের এম এ মতিন বাস টার্মিনাল এলাকায় একটি ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করে আসছেন।   

আয়েশা বেগম, স্বামী কছিম উদ্দিন, নতুন ভাঙ্গাবাড়ি, সিরাজগঞ্জ। স্থানীয় রাজাকাররা অভয় দেয়ায় তিনি নিজ বাড়িতেই ছিলেন। এরপর রাজাকাররা পাকসেনাদের গ্রামে ডেকে আনে। আয়শাকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। সেখানে টানা ২১ দিন তার ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। সেই ভয়াল স্মৃতি মনে হলেও এখনও কেঁদে ওঠেন এ বীরাঙ্গনা মাতা। 

সূর্য বেগম, স্বামী হারুনর রশিদ, নতুন ভাঙ্গাবাড়ি-সিরাজগঞ্জ। তার এক ফুফাতো ভাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। পার্শ্ববর্তী ফকিরতলায় মুক্তিযোদ্ধারা এক স্থানীয় রাজাকারকে মেরে ফেলে। এ কারণে পাকসেনারা ক্ষিপ্ত রাজাকারদের সাথে নিয়ে সূর্য বেগমের বাড়িতে হানা দিয়ে তাকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর টানা ২০ দিন ক্যাম্পে আটকে রেখে তার ওপর চলে নির্যাতন। অন্যের বাড়িতে আশ্রিত অসুস্থ সূর্য বেগম এখন মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে।

এছাড়া শহরের সয়াধানগড়া মহল্লার আবদুল মতিনের স্ত্রী মাহেলা বেগম, তেলকুপি এলাকার কহিনুর বেগম, যমুনা নদীর ক্লোজারসংলগ্ন শুকুর আলীর স্ত্রী সামিনা বেগম, মতিন সাহেবের ঘাট এলাকার শমসের আলীর স্ত্রী আয়মনা বেগম, পিটিআই, স্কুল এলাকার শামসুল আলমের স্ত্রী সুরাইয়া (ধুলি), সদর উপজেলার কান্দাপাড়া এলাকার হামিদা বেগম ও কালিয়াহরিপুর এলাকার আছিয়া বেগম, কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল ইউপির চানপুর গ্রামের মৃত হরিপদের স্ত্রী রাজুবালা, একই এলাকার জয়গন বেগম, করিমন বেগম ও হাজেরা বেগম এখনও বিচারের আশায় বেঁচে আছেন।  এসব বীরাঙ্গনা জানিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সংগ্রামের স্বীকৃতি সনদ পেয়েছেন। কিন্তু সম্ভ্রম হারিয়েও ৪৪ বছর আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাইনি। বর্তমান সরকার আমাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও আজও গেজেট প্রকাশ না হওয়ায় আমরা সনদ বা সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। দ্রুত সরকারি ঘোষণা বাস্তবায়ন দাবি করেছেন এই বীরাঙ্গনা মায়েরা।  
যারা আর নেই
বাহাতন বেগম, স্বামী শুকুর আলী, নতুন ভাঙ্গাবাড়ি, সিরাজগঞ্জ। ১৭ই এপ্রিল পাকসেনারা রাজাকারদের সহায়তায় তার স্বামীকে হত্যা করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ভয়ে বাহাতন পালিয়ে গেলেও ৩ মাস পর সে আবার বাড়িতে ফিরে আসলে পাকসেনারা তাকে ধরে ফেলে। এসময় ৮-৯ জন পাকসেনা তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। গ্রামের বৃদ্ধ মহিলারা এ দৃশ্য দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেও পাকসেনাদের মন গলাতে পারেনি। এরপর পর্যায়ক্রমে তার ছেলে মুসা ও ২ মেয়ে মরিয়ম ও হাসিনা রোগাক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। গত বছর তার মৃত্যু হয়। বীরাঙ্গনা আছিয়া খাতুন, স্বামী আবদুল মান্নান, নতুন ভাঙ্গাবাড়ি, সিরাজগঞ্জ। তার স্বামী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এ কারণে এলাকার রাজাকাররা আছিয়ার ওপর ক্ষিপ্ত ছিল। স্বামীর অনুপস্থিতিতে স্থানীয় রাজাকার বাদশাহ নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে রাখার নামে আছিয়াকে পার্শ্ববর্তী নলিছাপাড়ায় নিয়ে যায়। সেখানে তার ওপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। যুদ্ধ শেষে ফিরে এলেও তার স্বামী আর তাকে গ্রহণ করেনি। এরপর থেকে তিনি মেয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গত ৫ই নভেম্বর তিনি মারা যান। এছাড়াও শহরের সয়াধানগড়া মহল্লার আলাউদ্দিন সেখের স্ত্রী জোসনা বানু, চককোবদাসপাড়ার সূর্য বেগম, একই এলাকার আয়েশা বেগম, ঝর্না বেগম ও কামারখন্দ উপজেলার ঝাঐল এলাকার হাসিনা বেগমসহ চিহিৃত ১৭ জন ইতিমধ্যেই মারা গেছেন। সিরাজগঞ্জ উত্তরণ মহিলা সংস্থার পরিচালক ও মুক্তিযোদ্ধা সাফিনা লোহানী জানান, পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর বীরাঙ্গনারা আবারও ঠিকানাবিহীন হয়ে পড়েন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে পুনরায় তাদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এখনও ১৮ বীরাঙ্গনা নানা সমস্যায় দিন কাটাচ্ছেন। কিন্তু তাদের দেখার কেউ নেই। গত ৪৪ বছরে তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন ঘটেনি। কয়েক জন বীরাঙ্গনা সরকারি ভিজিএফ কর্মসূচির কার্ড পেয়েছেন। আর ২১শে পদকপ্রাপ্ত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু তার পদক প্রাপ্তির সাথে পাওয়া ১ লাখ টাকা বীরাঙ্গনাদের উৎসর্গ করেছেন এটাই বীরাঙ্গনাদের জীবনের বড় প্রাপ্তি। সিরাজগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার গাজী শফিকুল ইসলাম শফি জানান, মুক্তিযোদ্ধারা দেশ মাতৃকার জন্য সংগ্রাম করায় তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং তারা সরকারি নানা সুবিধা গ্রহণ করছেন। তেমনি বীরাঙ্গনারও সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও দেশের জন্য তারাও নিজের সম্ভ্রম হারিয়েছেন, ভোগ করেছেন পাশবিক নির্যাতন। এ অবস্থায় বর্র্তমান সরকার বীরাঙ্গনাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়ার উদ্যোগ নেয়ায় সাধুবাদ জানিয়ে দ্রুত তা বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন এ মুক্তিযোদ্ধারা।

সিরাজগঞ্জের সর্বশেষ সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।