বুধবার, ৬ নভেম্বর, ২০১৩

আব্দুল লতিফ মির্জা

গনতন্ত্রের জন্য দেশের স্বাধীকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অনেকের মত আর একটি নাম আব্দুল লতিফ মির্জা। ১৯৬৪ সালের কথা। শান্ত সৌম্য দীর্ঘদেহী সুদর্শন এক যুবক সিরাজগঞ্জ কলেজে ভর্তি হতে আসে। তখন দেশের ছাত্রসমাজ শিক্ষার অধিকারের দাবীতে আন্দোলন শুরু করেছে। জেলায় তখন দুটি ছাত্র সংগঠন শিক্ষা শান্তি প্রগতির মুল মন্ত্রে দিক্ষিত। বাংলাদেশ ( পুর্ব পাকিস্তান) ছাত্র লীগ ও শিক্ষা শান্তি ঐক্য প্রগতির মন্ত্রে দিক্ষিত বাংলাদেশ ( পুর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ইউনিয়ন) অন্দোলন করছে। আব্দুল লতিফ মির্জা ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয়েছিল। সদস্যপদ নিয়েছিল। ছাত্রলীগের একজন কর্মী থেকে খুব দ্রুত নেতৃত্বে চলে আসেন। সেই থেকে লতিফ মির্জার আন্দোলন সংগ্রামের পথ চলা। 
নিজের নেতৃত্বের গুনাবলি দিয়ে লতিফ মির্জা ছাত্র নেতা থেকে শ্রমিক নেতা। শ্রমিক নেতা থেকে জননেতার আসন নিয়েছিল। জনতার নেতা থেকে জনপ্রতিনিধিও হতে পেরেছিল। ৭১র মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কাছে আব্দুল লতিফ মির্জ্জা ছিল আতঙ্কিত এক নাম। ১৯৬৬ সালের কথা। বাঙ্গালী জাতিস্বত্বার দাবীসহ বাংলার স্বাধীকার, পশ্চিম পাকিস্তানি (পাঞ্জাব) শাসকদের শোষনের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লাহোরে বসে ৬ দফা দাবী উত্থাপন করেন। বাংলার পথে প্রান্তরে ৬ দফা দাবী জনতার নিকট পৌছে দেয়ার দায়িত্ব কাধে তুলে নিয়েছিল ছাত্রলীগ। ৬ দফা থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম শূরু হলে লতিফ মির্জার সাহসি ভুমিকা ছিল গৌরবান্বিত। ৬৯’র গনঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল দিনগুলিতে লতিফ মির্জা ছিল সবার আগে। গনঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাঙ্খিত স্বপ্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা। 
বীর বাঙ্গালী স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবীত হয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। সিরাজগঞ্জ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জ কলেজে যে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা হয়েছিল সেখানেও আব্দুল লতিফ মির্জার অসিম সাহসী ভুমিকা ছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সাথে যোগাযোগ রেখে সিরাজগঞ্জ কলেজে অস্ত্র ভান্ডার গড়ে তুলেছিল। মার্চের উত্তাল দিনে লতিফ মির্জার নেতৃত্বে উল্লাপাড়ার ঘাটিনা, বাঘাবাড়ি, পাবনার বেড়া প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। পাকিস্তানী শক্রবাহিনীকে প্রতিরোধে ঘাটিনা রেল সেতুর প্রান্তে যে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়েছিল লতিফ মির্জা তার বাহিনী নিয়ে মরনপণ যুদ্ধ করেছে। মার্চ থেকে এপ্রিল। সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ ভেঙ্গে পড়ে। মুল কারন ছিল পাকিস্তানী সৈন্যদের মত আমাদের হাতে অস্ত্র শস্ত্র ছিল না। প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ার পর আব্দুল লতিফ মির্জা তার বিশাল বাহিনী নিয়ে জনগনকে সাথে নিয়ে স্বাধীনতার জন্য মরনপণ যুদ্ধ শুরু করেন। গড়ে তুলেছিল পলাশডাঙ্গা যুবশিবির। 
পরিচালক হিসাবে পাকিস্তানী শক্রবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে যুদ্ধ করে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করেছে। হানাদার বাহিনীর অস্ত্র শস্ত্র কেড়ে নিয়ে মুক্তি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। তার উল্লেখযোগ্য যুদ্ধের মধ্যে তাড়াশের নওঁগা যুদ্ধ। এ যুদ্ধে নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও পাকিস্তানীদের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করেছিল। জীবন্ত ধরা হয়েছিল পাঞ্জাবী সেনা অফিসার। উদ্ধার করা হয়েছিল বিপুল পরিমান ভারি অস্ত্র শস্ত্র। স্বাধীনতার পর লতিফ মির্জা শ্রমিক সংগঠনের উপর গুরুত্ব দিয়ে কওমী জুটমিল সহ সিরাজগঞ্জ স্পিনিং ও তাঁত শ্রমিকদের সংগঠিত করে। শ্রমিক শ্রেনীর অধিকার আদায় ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় জাসদ এর রাজনীতীতে সক্রিয় ভুমিকা পালন করেছেন। উল্লাপাড়া থেকে জাসদ মনোনীত প্রার্থী হিসাবে প্রতিদ্বন্দিতা করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুল দল আওয়ামী লীগে প্রত্যাবর্তন করে দলের সাধারন সম্পাদক ও পরে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। 
আওয়ামীলীগ থেকেও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগৈর সভাপতির দায়িত্ব পালন কালে ৬ বছর আগে ৫ই নভেম্বর মারা যান। উল্লাপাড়া মোহনপুরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান আব্দুল লতিফ মির্জা ছাত্র শ্রমিক ও আওয়ামী লীগের রাজনীতি থেকে হয়ে উঠেছিলেন জননেতা। যেখানেই অবস্থান করেছেন সেখানেই নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্তরিকতার সাথে। রাজনীতিতে দ্বিমত থাকলে অকপটে প্রতিবাদ করেছেন। যা কিছুতে জড়িয়েছেন অসীম সাহসিকতার সাথে কাজ করেছেন। জেল জুলুমকে তুচ্ছজ্ঞান করে সাহসি ভুমিকা রেখেছেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতা বিরোধী ৭১র যুদ্ধাপরাধি, খুনি, মানবতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাজপথে ছিলেন লড়াকু সৈনিক হিসাবে। যুদ্ধাপরাধি জামায়াত বিএনপি জোট সরকারের অত্যাচার নির্যাতন, হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধেও ছিলেন সোচ্চার। জীবনের অনেক পথ পেরিয়ে বয়সের ভারাক্রান্ত। 
স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা পেয়েও আমরা হারিয়েছি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে। হারিয়েছি স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান সংগঠক সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহম্মদ, এম মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানকে। জাতীয়ভাবে তাদের ভুলে না গেলেও আমরা মন দিয়ে এই মহান বীরদের ভুলে যেতে বসেছি। সিরাজগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা আমীর হোসেন ভুলুও হারিয়ে গেছে। হয়ত আমরাও একদিন হারিয়ে যাব। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধীরে ধীরে মুক্তিযুদ্ধকেও ভুলেযাবে। নতুন প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের বলে যাব অতিতকে ভুলে গেলে নিজেরাও হারিয়ে যাবে অতল গর্ভে। সময় এসেছে এখনি মুৃক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করার।

সিরাজগঞ্জের সর্বশেষ সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।