৭ নভেম্বর নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা
Probhash Amin
৭ নভেম্বর বাংলাদেশের রাজনীতিতে খুবই আলোচিত, বিতর্কিত, গুরত্বপূর্ণ এবং জট লাগানো দিন। দিনটি একেকজন একেকভাবে পালন করে। আমি বিভ্রান্ত হয়ে যাই কার বিপ্লব, কে পালন করে; কার হাসি কে হাসে? বিএনপি দিনটি পালন করে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। কিন্তু ৭৫’র ৭ নভেম্বর তো বিএনপির জন্মই হয়নি। আর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান তখন ক্যান্টনমেন্টে গৃহবন্দি। এমনকি জিয়াউর রহমান তখন কাগজে কলমে কেউই ছিলেন না। ২৪ আগস্ট মোশতাক জিয়াকে সেনাপ্রধান বানালেও ৩ নভেম্বর ক্যু করে সেনাপ্রধান হন জেনারেল খালেদ মোশাররফ। নিজ বাসায় বন্দি হন জিয়া। এমনকি জান বাঁচাতে জিয়া তখন পদত্যাগ করে পূর্ণ পেনশন দেওয়ার আবেদন করেছিলেন।
খালেদ মোশাররফ জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দি করে বাসার ফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও তার বেডরুমের ফোন লাইনটি সচল ছিল। সেই ফোনেই তিনি কর্নেল তাহেরকে বলেছিলেন, ‘সেভ মাই লাইফ’। ডাক পেয়ে তাহের তার ‘সৈনিক সংস্থা’ নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। তাহের যে জিয়াকে ভালোবেসে তার জীবন বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, তা নয়। বিপ্লবের গোপন আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের সুযোগ ভেবেই মাঠে নেমেছিলেন তিনি। জাসদের মধ্যেই তখন অনেক বিভ্রান্তি। কর্নেল তাহেরের বিপ্লবের কথা জানতেনই না জাসদের অনেকে। ৭ নভেম্বর বিপ্লব হোক, প্রতিবিপ্লব হোক, ব্যর্থ বিপ্লব হোক, হঠকারিতা হোক– করেছে জাসদ। ৭ নভেম্বর তো বিএনপির সাফল্যের দিন নয়, জাসদের ব্যর্থতার দিন, সেটাই ঘটা করে পালন করে বিএনপি। পদচ্যুত, গৃহবন্দি সেনাপ্রধান ক্যু করতে পারেন, বিপ্লব নয়।
যে সৈনিক জিয়াকে নিয়ে উল্লাস করেছে তারা তো ছিল কর্নেল তাহের-এর অনুগত। রাস্তায় যে জনগণ সৈনিকদের সঙ্গে মিলে ট্যাংকের ওপর উঠে উল্লাস করেছে, তারা তো জাসদের কর্মী। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, যদি সেদিন জাসদের বিপ্লব সফল হতো; যদি জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের সাথে বেঈমানি না করতেন, যদি জিয়া তাহেরের স্ক্রিপ্ট ফলো করে শহীদ মিনারে গিয়ে বিপ্লবের ঘোষণা দিতেন; তাহলে আজ বাংলাদেশের রাজনীতির চিত্রটা কেমন হতো? আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকতো জাসদ, যেমনটা ছিল ৭৫’র আগে, বিএনপির হয়তো জন্মই হতো না। সত্যি রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
জাসদের বিপ্লব সফল হলে ভালো হতো, আমি এমনটা মনে করি না। জাসদের বিপ্লব সফল হলে কী হতো আসলে তা বলা মুশকিল। যারা বিপ্লবটি করতে চেয়েছিলেন, তারাও এর পরিণতি সম্পর্কে আদৌ জানতেন কিনা, আমার সন্দেহ। জাসদ আগে কী অপকর্ম করেছে, পরে কী করতে পারতো, সে আলাদা তর্ক। তবে অফিসারদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বিপ্লব ভালো কিছু বয়ে না আনারই কথা। আর সিরাজুল আলম খান যে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আফিম খাইয়ে ধ্বংস করেছেন একটি মেধাবী প্রজন্মকে, ৭ নভেম্বর কি তার চূড়ান্ত পরিণতি? জাসদের লোকজন কি তা বিশ্বাস করেন? সিরাজুল আলম খানের কি সায় ছিল ৭ নভেম্বরের তথাকথিত বিপ্লবে? মাত্র তিনবছর বয়সী একটা রাজনৈতিক দল কিছু ‘খ্যাপাটে সৈনিকে’র ওপর ভর করে মধ্যরাতে গুলি ফুটিয়ে সমাজতন্ত্র কায়েম করে ফেলবে? বিপ্লব কি এতই সহজ? ৭ নভেম্বর কি জাসদের বিপ্লব, নাকি স্বপ্নবান কর্নেল তাহেরের ইউটোপিয়ান বিপ্লব বিলাস? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর পাওয়া দায়।
৩ নভেম্বর ১৫ আগস্টের খুনি চক্রের বিরুদ্ধে ক্যু করেছিলেন খালেদ মোশাররফ। কিন্তু তিনি আর্মি ক্যু করতে চেয়েছিলেন সিভিলিয়ান স্টাইলে। আলাপ-আলোচনা-সমঝোতার সুযোগে কালক্ষেপণ হয়। বিভ্রান্তি ছড়ায়, গুজব ছড়ায়, ক্যুর শুরুতেই পলায়নপর খুনি চক্র কারাগারে হত্যা করে জাতীয় চারনেতাকে। এই ঘোলা জলে মাছ শিকার করতে নামে জাসদ, আরও স্পষ্ট করে বললে কর্নেল তাহের। তিনি জিয়াউর রহমানের মাথায় লবণ রেখে বরই খেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের সৈনিকদের উস্কানি দিতে যতটা পটু ছিলেন, জনসমাগম করতে ততটা নয়। জনগণ জাসদের পক্ষে ছিল না বলেই তাহেরের চেয়ে বেশি চালাক জিয়া বরইটি নিয়ে নিজেই খেয়ে ফেলেন। কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দিয়ে জিয়া ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন অবশ্যই। কারণ তাহের তাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন। কিন্তু কর্নেল তাহের বিপ্লবী ‘সৈনিক সংস্থা’ করে ক্যান্টনমেন্টে গোপন রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটানোর চেষ্টা করেছেন। তার বিপ্লবের মূল স্লোগান ছিল ‘সৈনিক সৈনিক ভাই ভাই, অফিসারের রক্ত চাই’। এ ধরনের হঠকারী তৎপরতা সবসময়ই অপরাধ। তবে ৭ নভেম্বরই জাসদের প্রথম হঠকারিতা নয়। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও, এমপি হত্যা, থানা লুট, ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ চেষ্টার চূড়ান্ত পরিণতি ৭ নভেম্বর। আর এই ৭ নভেম্বরেই জাসদের কফিনে শেষ পেরেকটুকু ঢুকেছিলেন কর্নেল তাহের।
৭ নভেম্বর নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষে অনেক আলোচনা হয়। কিন্তু সবচেয়ে কম আলোচনা হয় সবচেয়ে বেদনাদায়ক অধ্যায়টি নিয়েই। ৭ নভেম্বর আমরা হারিয়েছি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিন শ্রেষ্ঠ বীরকে। খালেদ মোশাররফ তো ছিলেন বীরদের বীর। কর্নেল হুদা আর কর্নেল হায়দারের বীরত্বও মুক্তিযুদ্ধের রূপকথার অংশ। খুনি চক্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়ে প্রাণ দেওয়া খালেদ মোশাররফ আজ যেন ভুলে যাওয়া নাম। শেখ হাসিনা ইতিহাসের অনেক দায় মিটিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, জেলহত্যা মামলার বিচার করেছেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছেন। এখন সময় খালেদ-হুদা-হায়দার হত্যার বিচার করার। ইতিহাসের দায় মেটাতে হবে সবাইকেই।
আওয়ামী লীগ-বিএনপি দুটি আলাদা রাজনৈতিক দল। তাদের আদর্শও আলাদা। যেমন ৭ নভেম্বর নিয়ে আওয়ামী লীগ বিএনপির অবস্থান সম্পূর্ণ আলাদা। কাগজে–কলমে বিএনপির জন্ম ১৯৭৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর হলেও এই দলটির আদর্শিক জন্ম এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়ার উত্থান এই ৭ নভেম্বরেই। তাই এই দিনটি তারা সাড়ম্বরে পালন করতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের মতো দিনটি স্মরণ করুক, জাসদ জাসদের মতো। কোনও অসুবিধা নেই। কিন্তু বিএনপিকেও বিএনপির মতো করে দিনটি উদযাপনের সুযোগ দিতে হবে। গণতন্ত্রে ভিন্নমত তো থাকবেই। সেই ভিন্নমতও প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে। ৭ নভেম্বর পালন নিয়ে বিএনপির অবস্থানের সঙ্গে আমারও যোজন যোজন ফারাক। কিন্তু আমি চাই তারা তাদের কথা স্বাধীনভাবে বলার সুযোগ পাক। অপরাধের বিচার করতে হবে। তবে রাজনীতির মোকাবিলা করতে হবে রাজনীতি দিয়েই, ক্ষমতায় থাকার সূত্রে পাওয়া প্রশাসনিক গায়ের জোরে নয়। ৭ নভেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়াউর রহমানের সমাধিতে যেতে না দেওয়া অন্যায়, অগণতান্ত্রিক। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি কনফারেন্সে আসা অতিথিদের নিরাপত্তাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে বেগম খালেদা জিয়াকে যেতে দেওয়া হয়নি। এক্ষেত্রে নেতাকর্মীদের চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা যেতো। কিন্তু বেগম জিয়াকে যেতে না দেওয়া ঠিক হয়নি। বেগম জিয়া শুধু একটি জনপ্রিয় ও বড় দলের চেয়াপারসনই নন; বাংলাদেশের তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীও। যে কোনও সময় তার নিরাপদ ও অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।
‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষ্যে বিএনপি প্রথমে ৮ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করতে চেয়েছিল। পরে তারা সমাবেশের তারিখ ১১ নভেম্বরে বদলে নেয়। সম্ভাব্য তারিখ আবার বদলানো হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তারা ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়েছে। গত কয়েকবছরের অভিজ্ঞতায় আমার আশঙ্কা, শেষ মুহূর্তে সরকার অনুমতি না দেওয়ার কথা জানাবে। তবে আমি চাই আমার আশঙ্কা মিথ্যা হোক। দাবি জানাচ্ছি, বিএনপিকে যেন নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে দেওয়া হয়। রাজনীতিতে শুভবুদ্ধির উদয় হোক। শত মতের বিকাশ ঘটুক।