শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

গণমাধ্যমে পেশাদারিত্ব ও সাংবাদিকতার অনিশ্চিত যাত্রা

আমীন আল রশীদ’র আরও লেখা
দৈনিক সকালের খবর পত্রিকার অফিসটি আমাদের অফিস লাগোয়া। ফলে ওই পত্রিকার কর্মী এবং আমরা ফুটপাথের একই দোকানে চা খেতাম। সাংবাদিক নেতা হেলাল ভাইয়ের সাথে ইয়ার্কি-মশকরা হতো। বস্তুত সকালের খবরের কয়েকজন রিপোর্টার আমাদের চায়ের আড্ডাকে প্রাণবন্ত করে রাখতেন। সেই মানুষগুলো এখন বেকার। চাকরি না পেলে আগামী মাস থেকে অনেককেই হয়তো বাকিতে চা খেতে হবে। আগামী মাস থেকেই তারা আর আমাদের সাথে এই ফুটপাথে একসঙ্গে চা খাবেন না। এটা মেনে নেয়া খুব কঠিন।

বৃহস্পতিবার (১৪ সেপ্টেম্বর) হঠাৎ করেই সংবাদটি আসে যে, সকালের খবর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকসহ কর্মীর সংখ্যা তিনশোর বেশি। এর কিছুদিন আগে বন্ধ হয়ে গেছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল যমুনা নিউজ।

দেশের গণমাধ্যমের এই সংকট নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের এক সহকর্মী জানালেন, দুই মাস ধরে তাদের বেতন বন্ধ। দৈনিক ইনকিলাবের কর্মীরা বছরের পর বছর বেতন পান না। দাবি আদায়ে তারা রাজপথেও নেমেছেন। কিন্তু তার ফল কী হয়েছে? ইংরেজি দৈনিক অবজারভারেরও একই অবস্থা ছিল। যদিও সেটি নতুন করে আবার প্রকাশিত হচ্ছে। রাজনৈতিক কারণে যখন দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দেয়া হলো, তখনও অনেক সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী বেকার হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে অনেকে নিশ্চয়ই এখনও বেকার। অনেকে হয়তো পেশা বদলে ফেলেছেন। আবার এই পত্রিকাটির একটি রাজনৈতিক এজেন্ডা ও তকমা থাকায় এর কর্মীদের পক্ষে অন্য কোথাও চাকরি পাওয়ায় বেশ কঠিন। যেমন কঠিন বন্ধ হয়ে যাওয়া দিগন্ত টিভির কর্মীদের অন্য কোনো টেলিভিশনে চাকরি পাওয়া।দিগন্ত টিভি বন্ধ হওয়ার পর অনেকে এখনও চাকরি পাননি বলে শোনা যায়। ফলে তাদের সংসার কী করে চলছে, তা আমরা জানি না। রাষ্ট্রও সেই খবর রাখার প্রয়োজনবোধ করে না। যেমন প্রয়োজনবোধ করবে না সকালের খবরের চাকরিচ্যুত কর্মীদের সংসার কী করে চলবে, সেই খবর রাখার। নিশ্চয়ই এই কর্মীদের মধ্যে কারো স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। কারো সন্তান হয়তো পৃথিবীতে আসবে এ মাসেই। এসে সে দেখবে তার বাবা একজন বেকার সাংবাদিক। এসে দেখবে তার জন্য পৃথিবীটা বাসযোগ্য করার যোগ্যতা তার অভিভাবকের নেই। অথচ তিনি সাংবাদিকতার মতো একটি ‘মহান’ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

২০০৭ সালে দৈনিক যায়যায়দিনের শতাধিক কর্মীকে একসঙ্গে ছাঁটাই করা হয়েছিল। ঈদের ছুটি শেষে অফিসে এসে দেখছিলাম অফিসের সামনে চাকরিচ্যুত কর্মীদের তালিকা টানানো। সেই তালিকায় নিজের নাম না দেখে খুব সৌভাগ্যবান মনে হয়েছিল। কিন্তু পরক্ষণেই যখন ভাবলাম, যাদের সাথে একসঙ্গে এতদিন কাজ করলাম পাশাপাশি চেয়ারে বসে, যাদের সঙ্গে ফুটপাথে মাসুদের দোকানে চা খেতাম, আড্ডা দিতাম, সেই মানুষগুলো এখন থেকে আর আমার সহকর্মী নন; বরং তারা এখন বেকার; যাদের মধ্যে অনেকেই (বস্তুত অধিকাংশই) বেতন পাওয়ার পরে ঘর ভাড়া দিতেন––সেই মানুষগুলো আগামী মাস থেকে কী করে চলবেন, এটি ভাবতে একটা শীতল অনুভূতি যেন রক্তের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়।

যায়যায়দিনের শুরুর দিনগুলোয় যার তত্ত্বাবধানে কাজ করতাম, এখন একটি টেলিভিশনের সিনিয়র পদে কর্মরত, সম্প্রতি জানালেন তিনি একটা নতুন সংবাদপত্রে যোগ দেয়ার কথা ভাবছেন। তাকে অনুরোধ করলাম জেনেশুনে এমন বিপদের দিকে পা না বাড়াতে। কারণ দেশের শীর্ষ কয়েকটি সংবাদপত্র বাদে বাকিদের যে দুরবস্থা, তা এই পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকলেই জানেন। সুতরাং ‘আপনি এখন একটা টেলিভিশনে ভালো অবস্থানে আছেন, নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন, সুতরাং এটা ছেড়ে একটা অনিশ্চিত গন্তব্যে কেন হাঁটবেন?’ আমার সেই অনুরোধ তিনি রাখবেন কি না জানি না।




সিরাজগঞ্জের সর্বশেষ সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।