লতিফ সিদ্দিকী এবার সরকারী মামলার জালে৷ |
পবিত্র হজ, মহানবী (সা.) ও তাবলিগ জামাত নিয়ে বিরূপ মন্তব্যকারী মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে সরকারি সম্পত্তি বিনা টেন্ডারে বিক্রি, তসরুপ ও অর্থ আত্মসাতের দায়ে কমপক্ষে অর্ধশত মামলা দায়ের করতে যাচ্ছে সরকার। বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী এবং যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মির্জা আজম এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পাট মন্ত্রণালয়ে থাকাকালে যেসব সরকারি মিল ও সরকারি জমি বিক্রি ও হস্তান্তর করেছেন, সেগুলোর বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আমাদের মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি নিরীক্ষা ও তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। আমরা এসব বিষয়ে পৃথকভাবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। তিনি বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত পেলেই প্রতিটি বিষয়ে আলাদা করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মির্জা আজম আরো বলেন, ঢাকার মতিঝিলের একটি জমি বেসরকারি একটি সমিতিকে প্রদানের বিষয়ে আইন মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে আইনি ব্যবস্থাসহ জমিটি ফেরত নেওয়ার জন্য মতামত দিয়েছে। ঈদের পর আমরা আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশের আলোকে সেই বিষয়টি বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তাদের কাছে যে প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে, তাতে বিভিন্নভাবে লতিফ সিদ্দিকীর আমলে ৪৮টি প্রতিষ্ঠান সরকারি স্বার্থের বাইরে বেচাবিক্রি ও হস্তান্তরের বিষয় চিহ্নিত করে অভিযোগ তোলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, এসব কাজে সরকারি নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা করেননি মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লতিফ সিদ্দিকী মন্ত্রী থাকাকালে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বিটিএমসি, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড, বিলুপ্ত বাংলাদেশ জুট করপোরেশন (বিজেসি), বিজেএমসিসহ বিভিন্ন বিভাগের কমপক্ষে ৪৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান বেসরকারীকরণ ও হস্তান্তর করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব সরকারি প্রতিষ্ঠান বেচাবিক্রি বা হস্তান্তরে কোনো নিয়মনীতি মানেননি লতিফ সিদ্দিকী। বরং তাঁর অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে সরকারের হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি বেহাত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই সব সরকারি সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তরের আগে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন গ্রহণ করা হয়নি। এমনকি টেন্ডার ছাড়াই শিল্পপ্রতিষ্ঠান হস্তান্তরে মন্ত্রী নিজের একক কর্তৃর্ত্ব ও সিদ্ধান্তে বেচাবিক্রি চূড়ান্ত করেছেন। সরকারি নিয়মের তোয়াক্কা না করে দরপত্র আহ্বানেরও পরোয়া করেননি। শুধু বেসরকারি ক্রেতাদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করেই মোটা অঙ্কের টাকা ঘুষ গ্রহণের মাধ্যমে তিনি সরকারি ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের বেচাবিক্রি ও হস্তান্তরপ্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছেন। পাট মন্ত্রণালয়ের একটি মেয়াদোত্তীর্ণ শাখা লিকুইডেশন সেলের মাধ্যমে লতিফ সিদ্দিকী তিন হাজার কোটি টাকা মূল্যের সরকারি তিনটি বস্ত্রকল বিক্রি করে দিয়েছেন।
ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দ্রুত লতিফ সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার এবং যেসব প্রতিষ্ঠান তিনি বিনা টেন্ডারে বিক্রি করেছেন তা ফেরত নেওয়ারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ তিনি নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রী থাকাবস্থায় শেষ সময়ে এসে তড়িঘড়ি করে ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতিকে ঢাকার g অবস্থিত বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের প্রায় ২০০ কোটি টাকা মূল্যের ১১ কাঠা ১৩ ছটাক জমি নামমাত্র মূল্যে দলিল করে দিয়েছেন।
এই জমি দিতে গিয়ে মন্ত্রণালয়ের একটি নোটের ৩৮৭ অনুচ্ছেদে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী লিখেছেন, 'ব্যক্তিগত জীবনে আমি চট্টলকন্যার পাণি গ্রহণ করেছি।' শর্ত সাপেক্ষে প্রতিবছর এক লাখ এক হাজার একশত এক টাকা লিজমানি ধার্য করে (এক কোটি এক লাখ এক হাজার একশত এক টাকা) ৯৯ বছরের জন্য ইজারা দেওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। এ টাকা এককালীন এক পে-অর্ডারে বস্ত্র মন্ত্রণালয়কে জমা দিতে চট্টগ্রাম সমিতিকে বলেছেন। এ জন্য সমিতিকে ১৫ দিন সময় দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, এ আদেশটি অবিলম্বে কার্যকরের কথাও নোট শিটে উল্লেখ করেন মন্ত্রী।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রাম সমিতিকে দেওয়া ১১ কাঠা ১৩ ছটাক জমি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন মতিঝিল মৌজার হোল্ডিং নম্বর ১৭৬, আরএস দাগ নম্বর ২৪৫৮, ঢাকা সিটি জরিপের দাগ নম্বর ৩৩৩৯-এর অন্তর্ভুক্ত।
জমির লিজ দলিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এটি পূর্ব পাকিস্তান সরকার নিশাত জুট মিলের মালিক মিয়া আবদুল হামিদের অনুকূলে ১৯৬২ সালের ১ মার্চ ৯৯ বছরের জন্য লিজ প্রদান করে। পরে জুট মিলটির মালিক পাকিস্তানি হওয়ায় বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে মিলটিকে জাতীয়করণ করে বিজেএমসির মালিকানাধীন রাখে। সেই থেকে এটি বিজেএমসির দখলে রয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের অন্য এক চিঠিতে দেখা যায়, অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে জমিটির মিউটেশন সম্পন্ন করে ১২ জানুয়ারি এ জমিটি ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি ট্রাস্টি বোর্ড চট্টগ্রাম ভবন, ৩২ তোপখানা রোড, ঢাকার অনুকূলে রেজিস্ট্রি দলিল সম্পাদন করা হয়। নতুন সরকার গঠনের পর নামমাত্র মূল্যে চট্টগ্রাম সমিতিকে দেওয়া জমির অনিয়মের বিষয়টি বেরিয়ে আসে। এর পরপরই এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানতে চাওয়া হয়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ টেঙ্টাইল মিলস করপোরেশনের (বিটিএমসি) আটটি, বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের দুটি, শ্রমিক-কর্মচারীদের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত তিনটি, লিকুইডেশন সেলের মাধ্যমে বিক্রীত তিনটি, বিজেএমসির একটি এবং বিজেসির ৩১টিসহ মোট ৪৮টি মিল-কারখানার সম্পত্তি বিক্রি ও হস্তান্তর করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি পূর্ণাঙ্গভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে এবং বাকি ১৭টি হস্তান্তর প্রক্রিয়াধীন, যার মধ্যে পাঁচটি নিয়ে মামলা বিচারাধীন।
তদন্ত প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বিনা টেন্ডারে হস্তান্তর বা হস্তান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে ১২টি প্রতিষ্ঠানের জমি। ওই ১২টির মধ্যে ঢাকার হাটখোলার বিটিএমসির উদ্বৃত্ত জমি আনসার ও ভিডিপি এবং পঞ্চগড়ের ভজনপুর পাট ক্রয়কেন্দ্র কেবল মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর একক সিদ্ধান্তের আলোকে বিনা মূল্যে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ঈগল স্টার টেঙ্টাইল মিলের সুদ মওকুফ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাইভেটাইজেশন কমিশন আইন ২০০০ এবং বেসরকারীকরণ নীতিমালা ২০০৭-এর ১১(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রাইভেটাইজেশন কমিশন ছাড়া অন্য কোনো মন্ত্রণালয় বা সংস্থা বেসরকারীকরণে ক্ষমতাপ্রাপ্ত নয়। এর পরও প্রাইভেটাইজেশন কমিশনের আপত্তি উপেক্ষা করে মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী সেই ২০০৯ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরে ৪৮টি সরকারি মিল ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের জমি বেসরকারি খাতে বিক্রি ও হস্তান্তর করেছেন।
জানা গেছে, লতিফ সিদ্দিকীর আমলে যে ৪৮টি প্রতিষ্ঠানের জমি বেচাবিক্রি ও হস্তান্তর করা হয়েছে, এর বিস্তারিত প্রতিবেদন ব্যাখ্যা ও আইনি দিক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা নিতে গেলে সরকারি সম্পত্তি অনিয়মতান্ত্রিকভাবে বিক্রি ও হস্তান্তরে শত কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন- এমন তথ্য বেরিয়ে আসতে পারে বলে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তারা