বুধবার, ৩০ নভেম্বর, ২০১৬

কাটাখালীর ইলিয়ট ব্রিজ

কাটাখালী নদীর শ্বাসরোধ করছেন মাছচাষিরা!

সেতুটি তৈরি করা হয়েছিল ১৮৯২ সালে। নাম ইলিয়ট ব্রিজ। ধনুকের মতো লোহার কাঠামো। পূর্ব প্রান্তে¦ ইবি সড়কের পাশে টিলার মতো উঁচু করে ধাপে ধাপে মাটি ফেলে রচনা করা সুদৃশ্য বাগান। মৌসুমি ফুল আর লতাগুল্মে সুশোভিত। পশ্চিম প্রান্তে বাগান নেই। এ পাড়ে খলিফাপট্টি। মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে কাটাখালী নদী।
কাটাখালীকে সিরাজগঞ্জ শহরের ধমনি বা হৃৎস্পন্দন বলেই মনে করে শহরবাসী। এর কারণ, এটি শহরের পানি নিষ্কাশনের একমাত্র মাধ্যম। নদীটি আছে বলেই বৃষ্টি-বাদল যতই প্রবল হোক, শহরে কোনো জলাবদ্ধতা হতো না। শহরের নৈসর্গিক পরিবেশের এক নান্দনিক রূপও ছিল কাটাখালী।
কাটাখালীর গলার কাঁটা হয়ে দেখা দিয়েছেন মাছচাষিরাও। কুড়িটির বেশি জায়গায় বাঁশ, জাল, মাটি ফেলে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এই অংশগুলোকে একেকটি বড় আকারের পুকুর বলে মনে হয়। বাঁধ দেওয়ায় পানির প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। যেসব এলাকায় মাছ চাষ হচ্ছে না, সেখানে কচুরিপানা আর জলজ উদ্ভিদে উপরিভাগ আচ্ছন্ন। পানি চোখে পড়ে না। এ ছাড়া বড় বাজার, ফজল খান রোড, কাঠের পুলসহ অনেক জায়গায় ফেলা হচ্ছে আবর্জনা। সেখানে ভাগাড়ের মতো অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু নদীর পাড় ভরাট করে দখলের প্রক্রিয়াও চলছে। ব্যাংক পাড়ায় নদীর পাড়ে মাটি ফেলে একাধিক বহুতল পাকা বাড়িও করা হয়েছে। ফলে ক্রমশ সংকীর্ণ হয়ে আসছে নদীর প্রস্থ।
ফলে নদীটি নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে সিরাজগঞ্জ শহরবাসী। ইলিয়ট ব্রিজের মাঝে কোনো স্তম্ভ নেই। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় নদীটির ওপর ২০টির মতো সরু, মাঝারি, চওড়া সেতু তৈরি করা হয়েছে। যেগুলো নদীর প্রবাহ ও সৌন্দর্যকে নষ্ট করেছে।
কাটাখালী নদী সিরাজগঞ্জ শহরের পুরাতন জেলখানার (বর্তমান শহররক্ষা বাঁধের হার্ড পয়েন্ট) কাছে যমুনা নদী থেকে বের হয়ে শহরের কালীবাড়ি, পিটিআই, সরকারি কলেজ পর্যন্ত এসে দুই ভাগ হয়েছে। এক শাখা গেছে শহীদ সোহরাওয়ার্দী রোড হয়ে শাহজাদপুরের হুরাসাগরের দিকে। এই অংশেই ইলিয়াট ব্রিজ। অন্য শাখা ভাঙাবাড়ী বাহিরগোলা হয়ে তেলকুপি দিয়ে নলকায় মিশেছে করতোয়া নদীতে। এই অংশে আছে ব্রিটিশ আমলের রেলসেতু। সংস্কারের অভাবে এটি এখন অবশ্য নড়বড়ে। কাটাখালী দিয়ে যখন লঞ্চ চলাচল করত, তখন এই সেতুটি দুই অংশে ভাগ হয়ে তীরের দিকে সরিয়ে নেওয়া হতো। মরচে ধরা সেই যন্ত্রগুলো এখন স্মৃতির মলিন সাক্ষী।
প্রবীণ ব্যক্তিরা জানালেন, কাটাখালী নদী একসময় শহরের একটি ব্যস্ত নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। লঞ্চ, গয়নার নৌকা ও মালবাহী বড় নৌকা এই নদী দিয়ে সিরাজগঞ্জ বন্দরে যাতায়াত করত। জানপুর পশ্চিমপাড়ার প্রবীণ বাসিন্দা ওয়াহিদ সরকার বললেন, স্বাধীনতার পরে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তবে ১৯৭৩-৭৪ সাল পর্যন্তও বড় নৌকা চলেছে। আশির দশক থেকে যখন নদীতে ঘের দিয়ে মাছ চাষ শুরু হয়, তখন থেকে নৌকা চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে।
কথা বলে বোঝা গেল, সিরাজগঞ্জের সর্বস্তরের মানুষের গভীর আবেগ আর প্রীতি জড়িয়ে আছে নদীটির সঙ্গে। সিরাজগঞ্জ পৌরসভা কাটাখালী নদী মাছ চাষের জন্য বার্ষিক চুক্তিতে ইজারা দেওয়া শুরু করেছিল আশির দশকে। এলাকাবাসী মনে করেন, মাছের ঘের দিয়েই নদীটির সর্বনাশ ডেকে আনা হয়েছে। সরকার ইজারা বাতিল করে নদীর দায়িত্ব জেলা প্রশাসনকে দিয়েছে। কিন্তু ইজারাদারেরা ২০০৪ সালে মামলা করে নদী তাদের দখলে রেখে দিয়েছে। মামলা চলতে থাকায় তাদের উচ্ছেদও করা হচ্ছে না। এই গ্যাঁড়াকলে পড়ে নদীটি শেষ হতে চলেছে। ১৮ ইজারাদারের এই অবস্থান পুরো সিরাজগঞ্জ শহরকেই বিপদাপন্ন করবে। ভুগবে নাগরিকেরা।
তবে সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সামিতির সাধারণ সম্পাদক, নদীর ইজারাদার ও মামলার বাদী শাহাদাত হোসেন বলেন, আদালত স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। মাছ থাকার কারণে জাল, বাঁশ, কাঠ এসব দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এতে পানির প্রবাহ কমে গেলেও একেবারে বন্ধ হয়নি।
সিরাজগঞ্জ স্বার্থ সংরক্ষণ কমিটির সদস্য নবকুমার কর্মকার, শিক্ষক আবদুল কুদ্দুছ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি আসাদ উদ্দিনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁরা বলেন, কাটাখালী নদীটির বাঁধ ও অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে দ্রুত নদীকে মুক্ত করা প্রয়োজন। খনন করে এর গভীরতা বাড়াতে হবে। তাঁরা বলেন, নদীর যমুনা প্রান্ত ও মুলিবাড়ী প্রান্তে দুটি স্লুইসগেট রয়েছে। এগুলোরও সংস্কার প্রয়োজন। বর্ষায় যমুনার পানি নদীতে এসে সব ময়লা-আবর্জনা ভাসিয়ে নলকা দিয়ে বাইরে নিয়ে যেত। বাঁধ দেওয়া ও স্লুইসগেট নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এই প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেছে। যে নদী শহরকে দূষণমুক্ত রাখত, সেটি দিনে দিনে দূষণের উৎসে পরিণত হতে যাচ্ছে।
পৌরসভার মেয়র সেলিম আহমেদ জানান, নদীর উন্নয়নের জন্য সরকারের জলবায়ু ট্রাস্ট থেকে ২৩ কোটি টাকা চেয়ে একটি প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল। প্রকল্পটি গৃহীত হয়নি। এর আগে ঢাকা রোড থেকে দত্তবাড়ী পর্যন্ত নদীর দুই পাশে পায়ে চলার পথ তৈরি করা হয়েছিল এবং নদীর পাড় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. বিল্লাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি জার্মানির একটি প্রতিনিধিদল নদীটি দেখে গেছে। একে বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তখন সব অবৈধ স্থাপনা ও দখলদারদের উচ্ছেদ করা হবে।

সিরাজগঞ্জের সর্বশেষ সংবাদ পেতে আমাদের সাথেই থাকুন।