বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর পুরানা পল্টনের ২৯/১ নম্বর বাসা 'ঠিকানা'র ছয়তলার একটি ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে প্রায় সাড়ে ৬৮ কেজি ওজনের ৫২৮টি স্বর্ণের বার ও চার বস্তা টাকা ও সৌদি রিয়াল উদ্ধার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত ওই টাকা ও রিয়াল গুণে শেষ করতে পারেনি উদ্ধারকারীরা। তবে এর পরিমাণ চার কোটিরও বেশি হবে ধারণা করা হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টদের ধারণা, উদ্ধার করা টাকা-মুদ্রা হুণ্ডির হতে পারে। আর স্বর্ণের বারগুলো চোরাচালানকৃত। উদ্ধার স্বর্ণের দাম প্রায় ৩০ কোটি টাকা। এ অভিযানে স্বর্ণ চোরাকারবারে জড়িত সন্দেহে ওই ফ্ল্যাটের মালিক মোহাম্মদ আলীকে গ্রেফতার করা হয়। নিজেকে আবাসন ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেওয়া এই ব্যক্তির দাবি, সিরাজগঞ্জের এক উপজেলা চেয়ারম্যান স্বর্ণের বারগুলো তার কাছে পাঠিয়েছেন। উদ্ধার করা টাকা ও সৌদি রিয়াল তার নিজের। যদিও এত টাকা-মুদ্রা ও স্বর্ণের বার কোথা থেকে এলো তার জবাব দিতে পারেননি তিনি। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মইনুল খান সমকালকে বলেন, 'গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ওই বাসায় অবৈধ স্বর্ণ ও মুদ্রা থাকার বিষয়টি আমরা জানতে পারি। এরপর ডিবি ও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ যৌথভাবে সেখানে অভিযান চালায়। দীর্ঘদিন ধরে তাকে অনুসরণ করা হচ্ছিল।' চূড়ান্তভাবে শনাক্তের পর বৃহস্পতিবার পুলিশের নিরাপত্তা সহায়তা নিয়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ এ অভিযান চালায় বলে জানান তিনি।
শুল্ক গোয়েন্দা অধিদফতরের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও ডিবির সহকারী কমিশনার মঞ্জুর মোর্শেদ সমকালকে জানান, পুরানা পল্টনের ২৯/১ নম্বর বাসার ছয়তলার ৬/এ ফ্ল্যাটে বিকেল ৫টার দিকে শুরু হয় অভিযান। সন্ধ্যা পর্যন্ত বাসার চারটি কক্ষে তল্লাশি চালিয়ে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ ও মুদ্রা পাওয়া যায়। টাকা ও সৌদি আরবের রিয়াল বান্ডিল করে বস্তায় ভরে রাখা ছিল। বস্তাগুলো পাওয়া যায় বিভিন্ন ঘরের খাটের নিচে। তারা জানান, এর মধ্যে বাংলাদেশি ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোট ছিল। এছাড়া স্বর্ণের ১৪০টি বার পাওয়া যায় ওয়্যারড্রোবের ভেতরে। এগুলো কালো কাপড়ের তৈরি প্যাকেটে মোড়ানো ছিল। পরে বাসার কাঠের তৈরি নকল ছাদের ওপর থেকে ছোট ছোট আরও কয়েকটি প্যাকেট উদ্ধার করা হয়। সেগুলোতে পাওয়া যায় প্রচুর স্বর্ণের বার। প্রাথমিক গণনা অনুযায়ী, উদ্ধার করা স্বর্ণের বারের সংখ্যা ৫২৮টি। এগুলোর প্রতিটির ওজন ১০ তোলা। ঘটনাস্থল এই ফ্ল্যাটসহ ওই ভবনের তিনটি ফ্ল্যাটের মালিক মোহাম্মদ আলী। সেগুলোতেও অভিযান চালানো হবে বলেও জানান গোয়েন্দারা।
এদিকে, অবৈধ স্বর্ণ ও মুদ্রা উদ্ধারের পর গৃহকর্তা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীকে গ্রেফতার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি দাবি করেন, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান মো. রিয়াজ স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত। পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি স্বর্ণের বারগুলো আপাতত রাখার জন্য তার কাছে পাঠিয়েছেন। এর সঙ্গে তার (মোহাম্মদ আলী) কোনো যোগাযোগ নেই। তিনি 'সাফা হোমস' নামে একটি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। পল্টনে তার ব্যবসায়িক কার্যালয়। পাশাপাশি ধানমণ্ডিতে 'আলী সুইটস' নামে তার একটি মিষ্টির দোকান রয়েছে।গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মোহাম্মদ আলী অস্বীকার করলেও তিনি আসলে একজন স্বর্ণ চোরাকারবারী। দেশি-বিদেশি মুদ্রা দিয়ে তিনি স্বর্ণ কিনতেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। টাকা-বিদেশি মুদ্রা তিনি নিজের বলে দাবি করলেও এত টাকা বাসায় বস্তাবন্দি করে রাখার কোনো কারণ দেখাতে পারেননি। উদ্ধার করা মুদ্রার পরিমাণ তিনি চার কোটির কিছু বেশি বলে জানিয়েছেন।অভিযানের পর গণনা শেষ হলে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে জানান তারা।
অভিযানের সময় ওই বাসায় ছিলেন মোহাম্মদ আলী, তার স্ত্রী রোজিনা বেগম, দুই ছেলে, এক মেয়ে, এক ভাতিজা এবং তিনজন গৃহকর্মী। ছেলে-মেয়েরা জানান, তাদের মা কিছুদিন ধরে অসুস্থ। তার সুস্থতা কামনা করে মাগরিবের নামাজের আগে মিলাদ পড়ানো চলছিল। এর মধ্যেই ডিবি ও শুল্ক গোয়েন্দা দল অভিযান চালায়। সিরাজগঞ্জের সদর উপজেলার চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিন সমকালের কাছে দাবি করেন. মো. আলী নামে কোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার পরিচয় নেই। স্বর্ণ চোরাচালানের ব্যাপারেও তিনি কিছু জানেন না।
রাত সাড়ে ৮টায় পর্যন্ত পুরানা পল্টনের ওই বাসায় অভিযান চলছিল। অভিযান সংশ্লিষ্টরা জানান, বাসায় তল্লাশি শেষ হলে মোহাম্মদ আলীর মিষ্টির দোকান ও পল্টনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালানো হবে। সেখানেও স্বর্ণ ও মুদ্রা লুকানো থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তথ্য পাওয়া গেলে তার চক্রের অপর সদস্যদের বাসাতেও তল্লাশি চালানো হবে।